ইমতিয়াজ আহমেদ ও রফিকুল ইসলাম (২০ এপ্রিল ২০২০):
করোনা ভাইরাসের কারণে স্থবির শিবচরের এক মাস কাটলো। গত মাসের ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রথম পর্যায়ে উপজেলার মাত্র চারটি এলাকাকে লকডাউনের ঘোষণা আসে। যে চারটি এলাকাতেই মূলত করোনা আক্রান্ত রোগী ছিল। এছাড়া পুরো উপজেলাতেই জনসমাগম এড়াতে গনপরিবহন বন্ধ ও নিত্যপন্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর রোগী বাড়তে থাকায় গত ৬ এপ্রিল থেকে পুরো উপজেলাকে আনুষ্ঠানিক লকডাউন ঘোষণা করা হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় উপজেলার সাথে আশেপাশের এলাকার সকল প্রবেশ পথ। এদিকে রবিবার শিবচরে আক্রান্তদের মধ্যে ৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরায় এবং নতুন করে কোন রোগী সনাক্ত না হওয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখছে উপজেলার সচেতন সমাজ। তবে এই আশার আলোর মধ্যেও শঙ্কা কাটেনি। উপজেলার গ্রাম পর্যায়ের এক শ্রেণির মানুষের আচরণে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে বলে মনে করে সচেতন মহল। ফলে রোগী কমলেও শঙ্কা কমেনি বলে মনে করেন তারা।
অবরুদ্ধ শিবচরের এক মাসঃ
এক জন ইতালি প্রবাসীর ঘরে ফেরার মধ্য দিয়ে করোনার বিস্তার ঘটে এই শিবচর উপজেলায়। শুধুমাত্র তথ্য গোপন করার খেসারত দিতে হয় উপজেলাবাসীকে। তথ্য গোপন করে ইতালি প্রবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাপনের ফলেই করোনার বিস্তার ঘটে যায়। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো করোনায় আক্রান্ত হয় ৪ জন। যা বিশ্বে বিরল। একজনের মৃত্যুও হয়। করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে এমনটা দেখে শুরু থেকেই দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া হয় শিবচরজুড়ে। ইতালি প্রবাসী অধ্যুষিত চারটি এলাকায় প্রথম পর্যায়ে পুলিশের কঠোর নিয়ন্ত্রন ছিল। এর পর পুরো উপজেলাতেই কঠোরতা অবলম্বন করে পুলিশ। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ করা হয়। সচেতন মহলও নিয়ম মেনে ঘরে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই ত্রিশ দিনে। এদিকে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ও বেড়াতে আসা বন্ধে বিভিন্ন এলাকার যুবকদের ক্যাম্পেইন করতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে এক মাস ধরে অবরুদ্ধ শিবচরের স্বাভাবিক জনজীবন কিছুটা থমকে আছে।
খাদ্য সহযোগিতাঃ
গত ১৯ মার্চ যখন চারটি এলাকাকে লকডাউন ঘোষণা করা হলো তখন ওই চারটি এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে খাদ্য সংকট নিয়ে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করেছিল। ঠিক সেই মূহুর্তেই জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরীর নির্দেশে অবরুদ্ধ এলাকায় খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা পৌছে দেয়া শুরু হয়। এর পর শুধু অবরুদ্ধ এলাকাই নয়, খেটে খাওয়া নানা শ্রেণি পেশার মানুষের ঘরেও পর্যায় ক্রমে খাদ্য সহায়তা পৌছে দেয়া শুরু হয়। পাশাপাশি প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এবং সামাজিক সংগঠনগুলোও নিজ নিজ এলাকার দরিদ্র মানুষের পাশে এগিয়ে আসতে শুরু করে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এই দূর্যোগকালীন সময়ে ১০ টাকা মূল্যের চাল, ভিজিডি, জেলে পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার খাদ্য সহায়তার আওতায় এসেছে। প্রশাসন থেকে প্রায় ৭ হাজার পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী দেয়া হয়েছে। নতুন নতুন তালিকা তৈরি হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আরো অসংখ্য পরিবার খাদ্য সহায়তার আওতায় আসবে।
চীফ হুইপের নজরদারিঃ
আধুনিক শিবচরের রূপকার জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী শিবচরে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছেন শিবচরকে। উপজেলা আওয়ামীলীগ ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে,প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক সবাইকে ঘরে থাকার আহব্বান প্রথম থেকেই কার্যকর করতে প্রশাসনের প্রতি চীফ হুইপের কড়া নির্দেশনা ছিল। এছাড়াও ঘরে থাকতে গিয়ে যাতে করে নি¤œ আয়ের মানুষের কষ্ট না হয় সেদিকটা সবার আগে বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য সহায়তা কার্যক্রমও প্রথম থেকেই চালু করেন তিনি।
শিবচর উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তি যোদ্ধা আলহাজ্ব সামসু্িদ্দন খান জানান,‘করোনা প্রতিরোধে চীফ হুইপ মহোদয়ের কঠোর দিকনির্দেশনা রয়েছে। করোনা আক্রান্তদের সঠিক সেবা দিতেও তার নির্দেশে বহেরাতলায় ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি সার্বক্ষনিক প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায়। তাতে করে সকলের মধ্যে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা চেতনা কাজ করেছে। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যেও মনোবল শক্ত হয়েছে।
প্রত্যন্ত গ্রামে ‘ঘরে থাকা’ মানছে নাঃ
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সিংহভাগ জেলার এই শিবচর উপজেলাতে হলেও প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন পর্যন্ত তেমন কোন সচেতনতাবোধ দেখা যায় নি। বিশেষ করে উপজেলার গ্রাম অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নিয়ম ভাঙার প্রবণতা খুব বেশি রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এই লকডাউনের মধ্যেও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বাড়িতে আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সরেজমিনে এবং উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রয়োজন ছাড়াই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামের মানুষ। সকাল এবং বিকাল স্থানীয় বাজারে অকারণেই আড্ডা বসছে তাদের। এছাড়া উপজেলার গ্রামের বাজারগুলোতে নেই কোন তদারকি। দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা, প্রতিদিন ভোরেই গ্রাম্য বাজারগুলো ‘হাটে’ পরিণত হয়। অসংখ্য মানুষের আনাগোনায় সচেতন মহলও উদ্বিগ্ন।
এ বিষয়ে আলাপ করলে একাধিক ব্যক্তি জানান, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকলেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গেলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পরতে হচ্ছে। গ্রামের বাজারগুলোতে নিরাপদ দূরত্ব মানা হচ্ছে না। মানুষের মধ্যেও তেমন কোন গুরুত্ব নেই। মাস্ক ঠিকই পরছে কিন্তু গায়ের সাথে গা মিশিয়ে বাজারে কেনাকাটা করছে। এতে করে সচেতন থেকেও তো পরিবেশ ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। কিচ্ছু করার নেই।’
প্রশাসনের বক্তব্যঃ
শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জানান,‘করোনা প্রতিরোধে শিবচরের পুলিশ প্রশাসন সর্বাতœকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি আমাদের কঠোর পদক্ষেপও রয়েছে। উপজেলার বাজারগুলোতে পুলিশের টহল অব্যাহত রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান জানান, আমরা সকল পরিস্থিতিতে মাঠে রয়েছি। চীফ হুইপ স্যারের নির্দেশে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা বাজারগুলো পর্যবেক্ষণ করছি, যাতে করে কেউ অতিরিক্ত দামে পন্য বিক্রি করতে না পারে। তাছাড়া করোনা প্রতিরোধে সরকারের মোতাবেক আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
Leave a Reply