করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং বন্ধ ঘোষণা করায় উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ শ্রেণি) থেকে মাস্টার্স শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যায়নরত কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে কলেজ, মাদ্রাসা, জাতীয় ও আরবি বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন থমকে গেছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকায় এসব শিক্ষার্থীরা মানুষিকভাবেও হতাশায় ভুগছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ঈদ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার চিন্তু ভাবনা করছে। দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে পরবর্তিতে বাড়তি ক্লাস নিয়েও সিলেবাস শেষ করা যাবে না। সেশন জটেরও আশঙ্কা রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মতো এসব শিক্ষার্থীদের সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠদান করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। এরপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের জোড়ালো দাবি তুলেন অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের গত ১৬ মার্চ সরকার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে দ্বিতীয় দফায় আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে। গত মঙ্গলবার সরকার ১১ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এসময় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঈদ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সরকার শিক্ষার্থীদের পাঠের মধ্যে রাখতে গত রবিবার ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে সংসদ টিভির মাধ্যমে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছে। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদেরও চলতি সপ্তাহের মধ্যে সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠদান করা হবে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন শিক্ষার্থী পাস করেছিল। তারাই এখন কলেজ ও মাদ্রাসার একাদশ শ্রেণিতে বা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পাঠদান থেকে দুরে রয়েছে। করোনার কারণে গত ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও তাও স্থগিত করা হয়েছে। ঈদের আগে পরীক্ষা হচ্ছে না বলে একাধিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। বাসায় কোয়েরেন্টাইনে থাকায় প্রায় সাড়ে ১১ লাখ পরীক্ষার্থীর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে চির ধরেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশে^র অনেক দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যলয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে চলছে। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে দেশের সরকারি-বেসরাকারি কলেজে অধ্যায়নরত ডিগ্রি (পাস), অনার্স ও মাস্টার্স শ্রেণিতে অধ্যায়নরত কয়েক লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের পাঠদানের বাইরে রয়েছে।
গত ২৩ মার্চ বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (্ইউজিসি) দেশের সকল বিশ^বিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা জারি করে। তাতে বলা হয়, বিশ^বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদেও অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। তা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিডি রেন) মাধ্যমে জুম অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে শিক্ষকদের পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিদের মাধ্যমে শিক্ষকদের যোগাযোগ করতে বলা হয়। কিন্তু জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ¯œাতক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত অন্তত পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীকে অনলাইনে পাঠদানের কোনো উদ্যোগ নেই। এ স্তরের শিক্ষার্থীরাও অলস সময় কাটাচ্ছে। একই অবস্থা আরবি বিশ^বিদ্যালয়ের অধীন ফাজিল ও কামিলস্তরের শিক্ষার্থীদের। এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসির ফোনে একাধিকবার কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি ও রাজধানীর কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, স্কুল লেভেলে সরকার টিভির মাধ্যমে পড়াশুনা চালু করেছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক। বাসায় থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা অস্তিরতা ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। মানুষিকভাবে শিক্ষার্থীদের সুস্থ রাখতে পাঠের মাধ্যমে বিজি রাখতে হবে। সরকারের বিষয়টি ভাবা উচিত। সব বিষয় দরকার নাই। অন্তত টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর পাঠদান চালু করা উচিত। এখন সব শিক্ষার্থী মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত। কলেজগুলো নিজ উদ্যোগে ফেসবুকের মাধ্যমে ম্যাসেজ বা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। এতে টাকাও খরচ হবে না। সরকারের নির্দেশনা ও প্রচারের মাধ্যমেই এটা করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতি অল্পতেই নিয়ন্ত্রণে আসলে আমরা বাড়তি ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবো । তেমন অসুবিধা হবে না। দীর্ঘ মেয়াদী ভেবে এখনই সিদ্বান্ত নিতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ক্লাস টিভিতে প্রচারের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা বিষয়টি ভেবে দেখবো।’
বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষাকে সব চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সরকারি পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের ল্যাবগুলো অত্যাধুনিক করেছে। শত শত কোটি টাকা খরচ করে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। শিক্ষকদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ছে। অথচ ৪৯টি পলিটেকনিক, ভোকেশনাল ইনিস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাসায় অলস সময় পার করছে। অনলাইনে পাঠদানের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
Leave a Reply