শিবচরনিউজ২৪.কম ডেস্কঃ
২০১৪ সালের ৪ আগস্ট দেশের দক্ষিনবঙ্গের প্রবেশদ্বার কাওড়াকান্দি-মাওয়া নৌরুটের পদ্মার মাঝে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় লঞ্চটি। সে সময় ঈদের ছুটি শেষে রাজধানী ঢাকায় ফিরতে ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ওভার লোডিংয়ের কারণে লঞ্চটি পদ্মায় ডুবে যায়। সরকারি হিসেবে ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ এবং বেসরকারিভাবে ৮৬ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সাঁতরে ও অন্যদের সহযোগিতায় জীবিত উদ্ধার হয় কিছু যাত্রী। নিখোঁজ থাকে ৫০ জন। যাদের খোঁজ আজো মিলেনি। এর মধ্যে আবার অজ্ঞাতনামা হিসেবে ঠাঁই হয় শিবচর পৌর কবরস্থানে ২১ লাশের।
২০১৪ সালের এই সময়টা ছিল রোজার ঈদ পরবর্তী দিন। যে ঈদের ছুটিতে পরিবার-পরিজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়ি ফেরা স্বজনেরা। আবার ঈদ শেষে কর্মস্থল ঢাকায় ফেরে জীবিকার লড়াইয়ে। এই সময়টায় পিনাক ডুবিতে নিহতের স্বজনের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। হারানো বেদনা নতুন করে ব্যথা বাড়িয়ে দেয় ক্ষততে।
শিবচরে পিনাক-৬ ডুবিতে স্বজন হারানো কয়েকটি পরিবারের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, এই দিনটিতে তারা হারানো স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনার জন্য দোয়া-মাহফিল করে থাকেন। মিলাদ-মাহফিল এর মাধ্যমে স্মরণ করেন তাদের।
জানা গেছে, কোনো কোনো পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সন্তান হারিয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা আজ সহায়হীন। অনাদরে বেঁচে আছেন মৃতের মতো পড়ে থেকে। মাদারীপুরের শিবচরে স্বজন হারানো কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বলতে গেলে দেখা যায়, নীরব-নিস্তব্ধ বাড়ির চারপাশজুড়ে যেন বিষাদের ছায়া।
পাঁচ্চর ইউনিয়নের লপ্তেরচর এলাকার নিহত মিজানুর রহমানের বাড়িতে গেলে দেখা যায় বৃদ্ধ মায়ের হাহাকার। আর চোখের অশ্রæজল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, যে কদিন বেঁচে থাকবেন আনন্দ আর আসবে না তার বয়সের ভাড়ে ন্যূজ হয়ে আসা এই জীবনে। ঠিক চার বছর আগের এই সময়টায় তিনি হারিয়েছেন তার সন্তান-পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিদের।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে স্বজন হারানো এই রিজিয়া বেগম বলেন, ‘আমি আর যে কদিন বেঁচে থাকবো, আমার জীবনে কোনো আনন্দ নেই। আমার জীবনের সবকিছু হারিয়ে গেছে পদ্মায়। সন্তান হারানো শোকে মিজানের বাবা নুরুল ইসলামও সবাইকে ছেড়ে চলে গেল। দুঃখ-বেদনা আর কষ্টের এই স্মৃতির সম্বল নিয়ে পড়ে আছি আমি।’
প্রতিবেশী শিরিন আক্তার বলেন, ‘চাচি সে বছর নাতি-নাতনিদের নতুন জামা কিনে দিয়েছিলেন। ঢাকা ফেরার সময় নিজ হাতে ওদের পরিয়ে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে ভেসে উঠলো পদ্মায়। চাচির সম্বল বলতে শুধু কয়েকটি ছবিই আছে।’ সেগুলো বুকে নিয়ে নীরবে শুধু কাঁদেন তিনি।
পদ্মায় লঞ্চ ডুবে নিহত এসব পরিবারের কষ্ট ছুঁয়ে যায় প্রতিবেশীদেরও। সংবাদকর্মীদের সামনে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবেশীকেও আবেগে চোখ মুছতে দেখা গেছে।
এমনই আরেক পরিবার শিবচর উপজেলার সন্যাসীচর ইউনিয়ের দৌলতপুর গ্রামের। ঢাকায় ফেরার পথে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পিনাক-৬ ডুবির দুর্ঘটনায় মারা যান ফরহাদ মাতুব্বর। স্ত্রী শিল্পী, এক বছর বয়সী সন্তান ফাহিম ও শ্যালক বিল্লালসহ সলিল সমাধি ঘটে তার। যাদের লাশও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
শিবচরের কাদিরপুর এলাকার মেধাবী দুই বোন ও তাদের এক খালাতো বোনেরও মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে এই দুর্ঘটনায়। ঈদের ছুটি কাটিয়ে বাবার সাথে ঢাকা ফিরছিল তারা। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর পদ্মার প্রবল স্রোত ঠেলে বাবা ভেসে উঠতে পারলেও সন্তানদের আর বাঁচাতে পারেননি। পাগলপ্রায় বাবার আহাজারিতে তখন পদ্মার বাতাস হয়ে উঠেছিল বিষাদে ভারাক্রান্ত। সেই বাবার আহাজারি থামেনি আজও। নিহত দুই বোনের বড় নুসরাত জাহান হিরা ঢাকার শিকদার মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। অপর বোন ফাতেমা-তুজ-জোহরা স্বর্ণা ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজে পড়তো। তারা খালাতো বোন জান্নাত নাঈম লাকীকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছিল।
বছরের এই সময়টায় স্বজন হারানো শিবচরের ১২ থেকে ১৪টি পরিবারে নতুন করে জাগিয়ে দেয় স্বজন হারানোর বেদনা।
Leave a Reply