রফিকুল ইসলাম রাজা, মাদারীপুর থেকে
কোটা আন্দোলনে গিয়ে কেউ হয়েছে নিহত, কারও পায়ে, কারও পেটে, কারো কোমরে আবার কারও চোখের পাশ দিয়ে গুলি লেগে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বেরিয়েছে। অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে আহত বহু মানুষ এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকা মেডিলেক কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড আর নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ)। বুলেটের দগদগে ক্ষত নিয়ে জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তারা।অনেকেই আবার নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারের কেউ জানেনা তারা কি নিহত না আহত নাকি কোথায় আছেন।
তাদেরই একজন শাকিল আহম্মেদ( ১৮)। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে গত ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।পরে তার কাছে থাকা ফোন থেকে ফোন আসে তার বোনের মোবাইল সে গুলি খেয়ে আহত হয়েছে। পরে পরিবার ও সহপাঠীদের সহযোগিতা তাকে নেওয়া হয় মিরপুরের একটি হাসপাতালে । সেখান থেকে আবার আনা হয় কল্যানপুর ইবনেসীনা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
আহত শাকিল মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার ভান্ডারীকান্দি ইউনিয়নের ক্রোকচর সরদারকান্দি এলাকায় মৃত্যু শিরাজ হাওলাদারের ছেলে।দুই ভাই বোনের মধ্য শাকিল ছোট।মরন ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শাকিলের বাবা মারা যাওয়ার পরে ছোট বেলা থেকেই দুই ভাই বোনকে নিয়ে মা সেলিনা বেগম চলে যান রাজধানীতে।বর্তমানে শাকিল শ্যামলী আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্র।বর্তমানে তারা ঢাকার মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় থাকেন।
রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাকিলের আহত হওয়ার একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে।ছবিতে দেখা যায়, একটি শয্যায় চিকিৎসাধীন শাকিল। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমেটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রোকন উদ্দিন মিয়া,শিবচরের বাঁশকান্দি ইউনিয়ন যুবদল নেতা সুজন বেপারী ও শাকিলের এক চাচা।পাশে আছে ছলছল চোখে মা ও বোন।
জানা য়ায়, গত ৪ আগষ্ট বন্ধু ও শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনে যাওয়ার সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেন শাকিল।পরিবারের লোকজন বাঁধা দিলেও সহপাঠী ও শিক্ষার্থীদের নিহত আহত হওয়ার খবর শুনেও শাকিল চলে যান কোটা আন্দোলনে।মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় যান তিনি। এসময় মলদ্বার দিয়ে গুলি লেগে বেরিয়ে যায় সামনের দিক দিয়ে।এতে প্রচুর রক্তক্ষরন হয়।ক্ষতস্থান দিয়ে যেন নেমেছিল রক্তের নহর। ফলে শরীরে দেখা দিয়েছে রক্তস্বল্পতা। তাকে বাঁচাতে গত ১০ দিনে ১৪ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। গুলিবিদ্ধ শরীরে করা হয়েছে ২ বার বড় ধরনের অস্ত্রোপচার। এদিকে অস্ত্রোপচারের পরে ড্রেসিং করাতে গিয়ে হয় আরো বিপদ।শুরু হয় রক্তপাত। পরে আবার গতকাল (শনিবার) দিবাগত রাত ১০ টার দিকে আরো একটি অস্ত্রোপচার করা হয়।তবুও শাকিল শঙ্কামুক্ত নন বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
শাকিলের বোন শাকিলার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান,ছোট বেলা বাবা আমাদের রেখে মারা যান।আমি ইবনেসিনা মেডিকেলে জব করি।সেদিন কোটা আন্দোলনে গিয়ে ভাইটা মারাত্মক আহত হন।পরে ওকে উদ্ধার করে মিরপুরের আলোক হাসপাতালে নেওয়া হয়।পরে নেওয়া হয় কল্যানপুরের ইবনেসিনা হাসপাতালে। এখন এখানেই আছে।
একটি বুলেট বিদ্ধ হয় ওর মলদ্বার দিয়ে।আরেকটি গুলিতে ওর এক পায়ের রগ ছিড়ে যায়।ইতোমধ্য তিনটি অপারেশন হয়েছে।এতে প্রায় ৩ লাখ টাকারমত বিল এসেছে। চিকিৎসক বলেছেন আরো ১ দেড় মাস লাগবে হাসপাতালে থাকতে হবে।একমাত্র ভাইয়ের অনিশ্চিত জীবন, চিকিৎসার জন্য দরকার অনেক টাকা আর রক্ত। এমন পরিস্থিতিতে সবকিছুর হাল ধরতে হয়েছে তাকে।তিনি আরো বলেন,এই মূহুর্তে আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার।
ছেলের এই অবস্থায় কীভাবে কী করবেন এসব ভেবে দুশ্চিন্তার অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন শাকিলের মা। তিনি মুঠোফোনে বলেন,বাবা শাকিলকে না করছি তুই কোন আন্দোলনে যাইস না। ও আমাকে বলে,’ আমাগো ভাই ব্রাদার মরে যাচ্ছে আমি গেলাম মা।সেই যে বর হলো এখনো হাসপাতালে আছে।নিজেকে কিছুটা শক্ত করে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাজানটার শরীর থাইকা অনেক রক্ত পইড়া গেছে। এহন ডাক্তার কইতাছে আল্লারে ডাকেন। রোগীর কী অবস্থা? এমন প্রশ্ন করা হলে, কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, ‘বাজান আমার এখন একটু সুস্থ্য।পেট ফাইরা অপারেশন করছে। প্রসাব,পায়খানার রাস্তায় কিছু নেই। অবস্থা একটু ভালো না। আপনেরা দোয়া কইরেন আমার বাজানের লিগা।গত দুই তিন দিন ধরে আমাদের শিবচরের, ঢাকার কে কে যেন এসেছিল কিছু টাকা দিছে।আরো অনেক টাকা দরকার। উন্নত চিকিৎসার দরকার।
শিবচরের বাশকান্দি ইউনিয়ন যুবদল নেতা সুজন বেপারী বলেন,আমরা একটি মাধ্যমে শুনে সেখানে যাই।গিয়ে দেখি ওর অবস্থা খুব খারাপ।ড্রেন করে পাইপ দিয়ে প্রসাব,পায়খানা করানো হয়।শাকিলের এই অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছে।আল্লাহ যেন তাকে দ্রুত সুস্থ করে দেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমেটির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রোকন উদ্দিন মিয়া বলেন, আন্দোলনে গিয়ে ছেলেটি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে সেখানে যাই। দেখে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। প্রথমত শুনতে পাই, ওর বাবা নেই। দ্বিতীয়ত মা যখন কাপড় সরিয়ে শরীর দেখালো তখন খুব কষ্ট হয়েছিল। এত সুন্দর, হাসি খুশি একটি ছেলে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। আমি চেষ্টা করবো ওর পাশে থাকার। তবে সবাই এগিয়ে এলে ছেলেটার সুচিকিৎসা হবে।
Leave a Reply